ল লাইফ রিপোর্টঃ ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম) সংশোধন করার বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে বিবাদী করা হয়েছে।
সোমবার (২৫ জানুয়ারি) অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারকের ছেলে ব্যারিস্টার মোস্তাসিম তানজিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবু তালেব এ লিগ্যাল নোটিশ পাঠান।
অ্যাডভোকেট আবু তালেব নিজেই নোটিশ পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, এর আগে ২০২০ সালের ২১ জুলাই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম) প্রয়োগ নিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল, জেলা জজ এবং পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পদমর্যাদাক্রম সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশ অনুযায়ী হয়নি। এ কারণে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
লিগ্যাল নোটিশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় আইনি প্রতিকার চেয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়া হবে বলে জানানো হয় নোটিশে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পদমর্যাদাক্রম হল একটি প্রোটোকল তালিকা বা রাষ্ট্রের নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের পদসমূহের ক্রমবিন্যাস। তবে একজন ব্যক্তি যখন একের অধিক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন তখন সর্বোচ্চ পদটিই এক্ষেত্রে গণ্য করা হয়।
এ পদমর্যাদাক্রম মূলত রাষ্ট্রীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ ও তাদের আসনের ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিদেশ গমন ও প্রত্যাবর্তনের সময় তাদের বিদায় ও অভ্যর্থনা জানানো এবং সমপর্যায়ের বিদেশি অতিথিদের দেশে স্বাগত ও পরে বিদায় জানানোর আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
২০২০ সালের ২০ জুলাই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম) প্রয়োগ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম-সচিব শফিউল আজিম স্বাক্ষরিত এ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে।
শুধু রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম) প্রয়োগ হবে। এজন্য ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স, ১৯৮৬ (২০০৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিমার্জিত)’-এ আনা হয়েছে সংশোধন।
ওই প্রজ্ঞাপন নিয়ে শফিউল আজিম তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সব রেফারেন্স দিয়ে সামারি তৈরি করে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার পর এটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
তিনি জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৪ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স জারি করা হয়। তখন শুধু রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে এর প্রয়োগ হতো।
১৯৭৫ সালের ১৬ অক্টোবর এবং ১৮৮৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২ অক্টোবর তৃতীয় দফায় এর সংশোধন করে রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারের অন্যসব ক্ষেত্রেও পদমর্যাদাক্রম প্রয়োগের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে জজদের মামলার কথা তুলে ধরে যুগ্ম-সচিব শফিউল আজিম তখন বলেছিলেন, ‘আমরা এখন বঙ্গবন্ধুর করা মূল ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে ফিরে গেলাম।’
এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সামরিক শাসক এরশাদের আমলে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে ‘অল পারপোজ অব দ্য গভর্মেন্ট’ কথাটি যোগ করায় বিভিন্ন ব্যক্তি এর সুবিধা নিচ্ছেলেন। এ নিয়ে নানা সমালোচনা থাকায় ওই কথাটা বাদ দেওয়া হয়েছে।
১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মো. আতাউর রহমান ২০০৬ সালে একটি রিট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় জেলা জজদের পদমর্যাদা সচিবদের নিচে দেখানো কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন উচ্চ আদালত।
রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দেওয়া রায়ে আটটি নির্দেশনা দেয়া হয়। সে অনুসারে নতুন তালিকা তৈরি করতে সরকারকে ৬০ দিন সময় বেঁধে দেন আদালত। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আদালত তা মঞ্জুর করে রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের সুযোগ দেন।
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল নিষ্পত্তি করে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগ ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি রায় দিয়েছিলেন।
সাংবিধানিক পদাধিকারীদের সবার উপরে রেখে এবং জেলা জজ ও সচিবদের মর্যাদা সমান করে রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম সংশোধনের চূড়ান্ত এ রায়টি ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্ট।