ল লাইফ রিপোর্ট: তুচ্ছ ঘটনা কে কেন্দ্র করে কোন মামলায় আসামিদের সাজা না দিয়ে এসব ক্ষেত্রে বিচারকদের মেডিয়েশনের(মধ্যস্থতা,সমঝোতা) ওপর গুরুত্ব দিতে রায় প্রকাশ করেছেন আপিল বিভাগ।
৩৫ বছর ধরে আদালতে চলা গাজীপুরে তুচ্ছ ঘটনার এক মামলা নিস্পত্তি করে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ রায় প্রকাশ করেন।
রায়ে তুচ্ছ ঘটনার জেরে দুই প্রতিবেশীর মামলাকে কেন্দ্র করে একজনের এক বছরের সাজার রায় বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টেও বহাল থাকায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন আাপিল বিভাগ।
সব্বোর্চ আদালত বলেছেন, এই ঘটনা ঘটেছিল দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তুচ্ছ একটা ঘটনার জের ধরে। এইসব ক্ষেত্রে আসামীকে ১(এক) বছরের জন্য জেলে না পাঠিয়ে প্রবেশনে রাখা সমীচিন ছিল।
রায়ে আপিল বিভাগ আরও বলেন, যেহেতু দন্ডবিধির ৩২৩ এবং ৩২৫ ধারা আপোষযোগ্য অপরাধ এবং যেহেতু দুই পক্ষ হচ্ছে পরস্পর আত্মীয়/প্রতিবেশী কাজেই মামলাটি আপোষ মীমাংসা করা যুক্তিযুক্ত ছিল। রায়ে বলা হয়,প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০”-এর বিধানাবলী বিচারিক আদালত, আপিল আদালত এবং হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রয়োগযোগ্য। অথচ আগের আদালতসমূহের তিনটি রায় থেকে বোঝা যাচ্ছে না যে, বিচারকগণ এই আইনের বিষয়ে আদৌ অবগত আছেন কিনা। যদি এই আইন প্রয়োগের বিষয়ে ধারণা থাকতো তাহলে রায়ের মধ্যে বলা থাকতো কেন এই আইন প্রয়োগ করা সমীচিন নয় এবং যদি এই আইন সঠিকভাবে বিচারিক আদালতে প্রয়োগ করা হতো তাহলে এই ধরণের মামলা আপিল বিভাগ পর্যন্ত আসতো না- বলে রায়ে মন্তব্য করেন সার্বোচ্চ আদালত।
আপিল বিভাগ বলেন, আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি, বিচারিক আদালতের বিচারক ও আপিল আদালতের বিচারক সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছেন যে, আমাদের দেশে “প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০” নামে একটি আইন আছে এবং বর্তমান মামলার প্রেক্ষাপটে সেই আইনের ৫ ধারা প্রয়োগযোগ্য। যখনই বিচারক ৩২৫ ধারার অপরাধে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করলেন তখনই উনার উচিত ছিল “প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০” -এর ৫ ধারা বিবেচনা করা। মামলার বিষয়বস্তু থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এই ঘটনা ঘটেছিল দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তুচ্ছ একটা ঘটনার জের ধরে। এইসব ক্ষেত্রে আসামীকে এক বছরের জন্য জেলে না পাঠিয়ে প্রবেশনে রাখা সমীচিন ছিল। এমনকি, যেহেতু দন্ডবিধির ৩২৩ এবং ৩২৫ ধারা আপোষযোগ্য আপরাধ এবং যেহেতু দুই পক্ষ হচ্ছে পরস্পর আত্মীয়/প্রতিবেশী কাজেই মামলাটি আপোষ মীমাংসা করা যুক্তিযুক্ত ছিল। আমরা আরো দুঃখের সাথে বলতে চাচ্ছি যে, এ ধরণের মামলার “প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০” প্রয়োগ না করা শুধু দুঃখজনকই নয় প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।
আদালত বলেন, বাংলাদেশের শতকরা ৬২ ভাগের অধিক লোক গ্রামাঞ্চলে বাস করে। যেখানে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শহরের তুলনায় বেশি এবং তাদের মধ্যে ছোট-খাটো ঝগড়া-বিবাদও বেশি হয়। এই মামলার ঘটনা শুরু হয়েছিল খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে। ১৯৮৬ সালের ১৪ জুলাই সন্ধ্যায় আসামি আব্দুল মতিনের সাথে বাদী আহমদ আলীর ১০/১২ বছরের নাতি আব্দুল বাকির কথা কাটাকাটি হয়। ওইদিনই সন্ধ্যায় এই ব্যাপারে সালিশ হয় এবং মতিনকে সালিশে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ফলে আসামিপক্ষ প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেয় এবং পরের দিন সকাল ছয়টায় আসামী মতিনের ভাই আসামী নুর মোহাম্মদ বাদীর ছেলে আব্দুল জব্বারকে আক্রমণ করে এবং একটি ফালার চ্যাপ্টা অংশ দিয়ে মাথায় আঘাত করে একাধিক রক্তাক্ত জখম করে এবং তার বাম হাতের কব্জি ভেঙ্গে দেয়। মোট ৬ (ছয়) জন আসামি বাদী পক্ষের ৪(চার) জনের শরীরে বিভিন্ন আকারের জখমকরে। এর মধ্যে আব্দুল জব্বার সবচেয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়।
বিচার শেষে ১৯৯৪ সালের ৩১ জানুয়ারি বিচারক বর্তমান আবেদনকারী নুর মোহাম্মদকে দন্ডবিধির ৩২৫ ধারার অপরাধের জন্য এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং ৩২৩ ধারার অপরাধের জন্য দুই হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো তিন মাসের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। অন্যান্য আসামীদেরকে দন্ডবিধির ৩২৩ ধারার অপরাধের জন্য যথাক্রমে দু্ই হাজার টাকা এবং পাঁচশত টাকা জরিমানা করেন।এর বিরুদ্ধে আসামিরা অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন। যেটি ২০০৫ সালের ৭ জুলাই খারিজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আসামিরা হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করেন।শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২ মার্চ আবেদনটি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।হাইকোর্ট বিভাগের ওই খারিজাদেশের বিরুদ্ধে আসামি নুর মোহাম্মদ আপিল বিভাগে আবেদন করেন। শুনানি শেষে রায় দেন আপিল বিভাগ।
রায়ে আরো বলা হয়, ইতোমধ্যে আবেদনকারী নুর মোহাম্মদ ৩১(একত্রিশ) দিন কারাদন্ড ভোগ করেছেন। আবেদনকারী নুর মোহাম্মদের দোষী সাব্যস্তের আদেশ এবং জরিমানা বহাল থাকবে। তবে তিনি যতদিন কারাদন্ড ভোগ করেছেন ততদিনই তার দন্ড হিসেবে গণ্য হবে উল্লেখ করে নুর মোহাম্মদের আবেদন নিষ্পত্তি করে দেন আপিল বিভাগ।
আপিল বিভাগের এ রায়কে যুগান্তকারী রায় বলে অ্যাখ্যায়িত করেছেন বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল মেডিয়েশন সোসাইটির(বিমস) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এস এন গোস্বামী। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এ রায় অনুসরণ করে বিচারকগণ বিরোধ মীমাংসায় মেডিয়েশন পদ্ধতি প্রয়োগের ওপর জোর দিবেন বলে প্রত্যাশা করছি।
( বি.দ্র: বাংলাদেশ ল’ টাইমস থেকে প্রকাশিত 29 BLT-(A.D)29 পৃষ্টায় এ রায় প্রকাশ করা হয়েছে।)