বিচারপতি রাধা বিনোদ পাল
আজকের এই পর্বে আমি বাংলার আইন অঙ্গনের কিংবদন্তী বিচারপতি রাধা বিনোদ পাল এর জীবনী নিয়ে আলোকপাত করব। বিচারপতি রাধা বিনোদ পাল বৃটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশের) কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানার সালিমপুর গ্রামে ১৮৮৬ সনের ২৭ জানুয়ারী জন্ম গ্রহন করেন। তিনি কুষ্টিয়ার তারাগুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহন করেন এবং রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯০৩ সালে এন্ট্রাস ও ১৯০৫ সালে এফ, এ পাশ করেন। এরপর তিনি গনিত বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্ত্তি হন এবং ১৯০৭ সালে গনিত বিষয়ে অনার্স ও ১৯০৮ সালে গনিত বিষয়ে মাষ্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ভারতের এলাহাবাদ একাউন্টস জেনারেল অফিসে কিছুদিন কেরানীর চাকুরী করেন। এরপর তিনি ১৯১১ সনে আইন বিষয়ে বিএল ডিগ্রী অর্জন করেন।
এরপর তিনি ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে গনিত বিষয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং পাশাপাশি তিনি ময়মনসিংহ আদালতে ওকালতি শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি আইনে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলএম কোর্সে ভর্ত্তি হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯২০ সনে এলএলএম পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং কলকাতা হাইকোর্টে একজন আইনজীবী হিসাবে পেশাগত কাজ শুরু করেন। ১৯২২ সালে ভারতীয় আয়কর আইন তৈরিতে তিনি প্রধান ভুমিকা পালন করেন। ১৯২৭ সালে তিনি ভারতীয় ব্রিটিশ সরকারের উপদেষ্টা মনোনিত হন। ১৯৪১ সনে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ পান। ১৯৪৪ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসাবে নিয়োগ পান।
বিচারপতি রাধা বিনোদপাল ও টোকিও ট্রায়ালঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৪৬ সালে জাপানের রাজধানী টোকিওতে একটি আন্তজাতিক ট্রাইবুনাল গঠিত হয়। সেই ট্রাইবুনালে ১১ জন বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি রাধা বিনোদ পাল নিয়োগ প্রাপ্ত হন এবং ন্যায় বিচারের দৃস্টান্ত স্থাপন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৬-৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জাপানের রাজধানী টোকিও মহানগরে জাপানকে নানচিং গণহত্যা সহ দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধে চীনাদের উপর জাপানি সেনাবাহিনীর দীর্ঘ কয়েক দশকের নৃশংসতার অভিযোগে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করে যে বিশেষ আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হয়, তিনি ছিলেন সেই আদালতের অন্যতম বিচারপতি। তিনি তার ৮০০ পৃষ্ঠার বিচক্ষণ রায় দিয়ে জাপানকে “যুদ্ধাপরাধ”-এর অভিযোগ থেকে মুক্ত করেন। এ রায় বিশ্বনন্দিত ঐতিহাসিক রায়ের মর্যাদা লাভ করে। তার এ রায় জাপানকে সহিংসতার দীর্ঘ পরম্পরা ত্যাগ করে সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশে প্রধানতম সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। রাধাবিনোদ পালকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করা হয় নিহোন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ১৯৬৬ সাল। জাপান সম্রাট হিরোহিতোর কাছ থেকে জাপানের সর্বোচ্চ সম্মানীয় পদক ‘কোক্কা কুনশোও’ গ্রহণ করেছিলেন। জাপানের রাজধানী টোকিও তে তার নামে রাস্তা রয়েছে। কিয়োটো শহরে তার নামে রয়েছে জাদুঘর, রাস্তার নামকরণ ও স্ট্যাচু।
জাতি গঠনের পিছনে জাপানীরা চিরকৃতজ্ঞ কুষ্টিয়ায় জন্ম নেয়া একজন বাঙালির কাছে। মিত্রপক্ষের চাপ সত্বেও ইন্টারন্যাশনাল যুদ্ধাপরাধ টাইব্যুনালের ‘টোকিও ট্রায়াল’ ফেজে এই বাঙালি বিচারকের দৃঢ় অবস্থানের কারণেই জাপান অনেক কম ক্ষতিপূরণের উপরে বেঁচে গিয়েছিলো। নয়ত যে ক্ষতিপূরণের বোঝা মিত্রপক্ষ ও অন্য বিচারকরা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তার দায় এখন পর্যন্ত টানতে হত জাপানকে। সেক্ষেত্রে ঋণের বোঝা টানতে টানতে জাতি গঠনের সুযোগই আর পাওয়া হত না জাপানের।
সূর্যোদয়ের দেশ জাপান বর্তমান পৃথিবীর শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোর ভিতর প্রথম অবস্থানে রয়েছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর শিল্পে অনেক তাড়াতাড়ি সমৃদ্ধি অর্জন করে দেশটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাপান বাংলাদেশ এর পক্ষ নেয়। এমনকি যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে জাপানের ভূমিকা ছিলো অনেক। বাংলাদেশের প্রতি জাপানের এই ধরনের স্বার্থহীন বন্ধুত্বসুলভ আচরণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সাধারণত দেখা যায় না। জাপানের বাংলাদেশকে এরূপ সাহায্যদানের পিছনে রয়েছে বিচারপতি রাধা বিনোদ পাল এর কৃতিত্ব।
পরবর্তীতে বিচারপতি রাধা বিনোদ পাল পুনরায় নেদারল্যান্ডের হ্যাগে অবস্থিত আন্তজার্তিক আদালতে বিচারক হিসাবে নিয়োগ পেয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সহিত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিচারপতি রাধা বিনোদপাল আমাদের জন্য অনুপ্রেরনা। বাঙ্গালী হিসাবে সত্যিই আমরা গর্বিত।
মৃত্যুঃ গুনী এই বিচারপতি ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি কলকাতায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লিখেছেনঃ আলমগীর হোসেন, এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।