ভার্চুয়াল কোর্ট মুলতঃ শারীরিক উপস্থিতি ব্যাতিরেকে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে (বিচারক, পক্ষগনের আইনজীবী) বিচার কার্য সম্পন্ন করা। উচ্চ আদালতে ভার্চুয়াল কোর্ট আপীল বিভাগে জরুরী মামলার জন্য চেম্বার জজ ও হাইকোর্ট বিভাগে জরুরী মামলায় ভার্চুয়াল কোর্টে উপস্থাপন, শুনানী গ্রহন এর লক্ষ্যে পৃথক পৃথক প্র্যাকটিস নির্দেশনা গত ১০মে’২০ জারী হয়েছে। দীর্ঘদিন করোনা মহামারী জনিত কারনে নিয়মিত কোর্ট না চলায় সময়ের চাহিদার প্রেক্ষিতে ও সাংবিধানিক প্রয়োজনে ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনা অধ্যাদেশ ০১/২০২০ গত ৯মে’২০ মহামান্য রাষ্ট্রপতি জারী করেন। প্রকৃত ভার্চুয়াল কোর্ট করতে গেলে বহুমুখী সুবিধার অভাব রয়েছে কোর্ট, বিচারক, আইনজীবীদের। নেই ভার্চুয়াল চালান, নেই ভার্চুয়াল কোর্ট ফি অর্থাৎ ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনায় রয়ে গেছে সনাতন পদ্ধতির মিশ্রন। ভার্চুয়াল কোর্টে মামলার আবেদনসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র(ওকালতনামাসহ) নিজ মেইল থেকে নির্দিষ্ট কোর্ট বরাবরে pdf পদ্ধতিতে স্ক্যানিং/ আপলোড করতে হবে।মামলা জরুরী ভিত্তিতে ভার্চুয়াল কোর্টে শুনানীর জন্য প্র্যাকটিস ডাইরেকশন এর বিধি ১ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কোর্ট বরাবরে কারন উল্লেখপূর্বক ১(এক) পৃষ্ঠায় আবেদন করতে হবে। সংযোজিত কাগজপত্র জাল বা অসত্য নহে এবং যদি জাল বা অসত্য হয় দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে বহন করতে হবে মর্মে Undertaking দিতে হবে।বিচারক শুনানীর পূর্বে জরুরি আবেদন পর্যবেক্ষণ করে ভার্চুয়াল কেস নাম্বারসহ শুনানীর তারিখ ও সময় কোর্ট এসোসিয়েট এর মাধ্যমে প্রেরণের নির্দেশনা রয়েছে। বাস্তবে আমরা জানি গুগুলস্ ড্রাইবে বিনামূল্যে মেইল এর ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ১৫ জি.বি কিন্তু এর বেশী হলে গুগুলস্ থেকে জি.বি(গিগাবাইট) বা টি.বি (টেরাবাইট) কিনে নিতে হয়। ১৫ জি. বি’র বেশী মেইলে লোড হলে গুগুলস্ ড্রাইব আর আপলোড নিবে না। অনেক আইনজীবী বন্ধু বিশেষকরে ফৌজদারী মামলায় জামিন, আগাম জামিন, পেন্ডিং আপীলে জামিনের জন্য আবেদন করেছেন শুনেছি। অনেকে আবার pdf ফরমে না করে জেনারেল ফরমে, জরুরী ভিত্তিতে ভার্চুয়াল শুনানির আবেদনই করেননি বা স্ক্যানিং এর কাগজপত্রের বিষয়ে Undertaking ই দেননি বা নিজ মেইল থেকে আবেদন করার কথা থাকলেও বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে মেইলে আবেদন করেছেন। ২/৪ জন বিজ্ঞ বন্ধু আমাকে ফোন করে বলেছেন ভাই আমার মামলা দৈনিক কার্য তালিকায় আসলো না, তখন তাঁকে ফাইলিং সিস্টেম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি, তখন তিনি বলেছেন pdf ফরমে আবেদন করতে পারি নাই, কেউ বলেছেন urgent petition for virtual hearing দেই নাই, কেউ বলেছেন আগাম জামিন বা পেন্ডিং আপীলে জামিন আবেদন করেছি। এ সমস্ত ভূলের কারনে হয়তোবা শুনানীর তালিকায় আসেনি। পত্রিকা / মিডিয়াসহ সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণে দেখা যায় এনেক্স ৫নং কোর্টে প্রায় ১১০০ টি বিভিন্ন ফৌজদারী মামলার আবেদন শুনানীর জন্য জমা পড়েছে। ৬টি বিচার কার্য দিবসে ১৬৭ টি মামলা কার্য তালিকায় এসেছে, ৯০টিতে জামিন মন্জুর হয়েছে। অপর ভার্চুয়াল কোর্ট নং পুরাতন ৯ ফৌজদারি মামলা ৪টি কার্য দিবসে কার্য তালিকায় এসেছে ৭১ টি (পেন্ডিং আপীলসহ) এবং জামিন মন্জুর হয়েছে ১২টিতে। জামিন মন্জুর হয়ে যাবার পর প্র্যাকটিস নির্দেশনার ১৩ নং বিধি অনুযায়ী বিচারকের আদেশ scanned ও upload হয়ে যাবার পর নিম্ন আদালত, পক্ষগন ও এটর্ণী জেনারেল অফিসে মেইলে প্রেরণের কথা থাকলেও পক্ষগনকে পাঠানো হচ্ছে না। নিম্ন আদালতে জামিনের আদেশ চলে যাবার পর জামিননামা দাখিলের ভার্চুয়াল আবেদন, শুনানী, রিলিজ দাখিলের(কোর্ট ফিসহ) আদেশ যাহা scanned ও upload করে জেলখানায় প্রেরণ। এইসব বিষয়ের মধ্যে আবার সনাতন পদ্ধতির সংমিশ্রণ। এতে করে শুনানী ও আদেশ উচ্চ আদালত থেকে দ্রুত হলেও আসামী দ্রুত জেলখানা থেকে রিলিজ হওয়ার সুযোগ হচ্ছে না। অপরদিকে, লকডাউনের মধ্যে অধ্যাদেশ জারী ও ভার্চুয়াল কোর্ট দ্রুত শুরু হওয়া, আইনজীবীদের প্রশিক্ষণের অভাব, কম্পিউটার, স্ক্যানার ও অ্যান্ড্রয়েড ফোন এর অভাব, কোর্ট ফি লাগানো, জেলখানা থেকে ওকালতনামা সংগ্রহ, অপর্যাপ্ত ভার্চুয়াল কোর্ট এসব মিলিয়ে বিশাল প্রতিবন্ধকতা থাকায় আইনজীবীদের ৯৯% ভার্চুয়াল কোর্ট এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
প্রতিকারঃ ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনার জন্য বিচারকদের গুগুলস্ ড্রাইবে unlimited access সৃষ্টি করা বা সাপোর্ট দেওয়া, অটোমেশন সিস্টেমে বিচারকের শুনানীর গুরুত্ব বিবেচনার পর অটোনাম্বার পড়া, বিচারকের আদেশ পক্ষগনসহ সংশ্লিষ্ট কোর্টে, জেলখানায় অটোমেশন সিস্টেমে ই-মেইলে প্রেরণের access সৃষ্টি করা। বিকাশ বা পে – কার্ড এর মাধ্যমে চালান বা কোর্ট ফি ‘র টাকা পরিশোধের access সৃষ্টি করা। আইনজীবীদের দ্রুত অনলাইনে প্রশিক্ষন দেওয়া এবং অনলাইন প্রশিক্ষন সব সময় উম্মুক্ত রাখা।আইনজীবীদেরও উচিত নিজ মেইল থেকে scanned করে pdf ফরমে মেইলে পাঠানো, না হয় কখনোই শুনানীর জন্য কার্য তালিকায় আসবেনা। শুনানীর জন্য অধ্যাদেশ অনুযায়ী শুনানীর ক্ষেত্র এবং কোর্ট বাড়ানো। মহামারী বা যে কোন দুর্যোগকালীন সময়ে বা ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল সুবিধা কাজে লাগিয়ে মহামারীত্তোর সপ্তাহে একদিন নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত ভার্চুয়াল কোর্ট চালু রাখা।আইনজীবীদেরও গুগুলস্ ড্রাইবে পর্যাপ্ত স্পেস কম্পিউটার / মোবাইলে খালি রাখা নাহলে কম্পিউটার বা মোবাইল হ্যাং হয়ে যেতে পারে। একই আইনজীবী, একই মামলার আবেদন না বুঝে বারংবার upload করে মেইলে পাঠানো থেকে বিরত থাকা।কিছু কিছু প্রিন্টিং / ইলেকট্রনিক মিডিয়া নিউজের চাকচিক্য বাড়ানোর লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট করে নিউজ না করে গন নিউজ করা যেমন- ভার্চুয়াল কোর্টে ….. হাজার জামিন মন্জুর বা চিহ্নিত সন্ত্রাসী অমুক বা দুর্নীতিবাজ বা ব্যাংক টাকা লুটপাটকরী অমুকের জামিন মন্জুর। এতে করে সমাজে বিরুপ প্রতিক্রিয়া পড়ে।কোন আদালত থেকে কতজন বা কে, কে জামিন হয়েছে তা সংবাদকর্মীর উচিত সুনির্দিষ্ট করে সংবাদ প্রকাশ করা। মহামারী যদি দীর্ঘ সময় চলমান থাকে এবং লকডাউন চলতে থাকে তাহলে আইনজীবী, বিচারপ্রার্থীগনের ভার্চুয়াল কোর্টের সুবিধা নেওয়া ছাড়া বিকল্প পথ নেই। ভার্চুয়াল কোর্টের ধারণার ক্ষেত্রে আইনজীবীদের উচিত পরস্পরকে সহযোগীতা করা, তাহলে ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে ডিজিটাল আইনী কাঠামোর নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
মোঃ মোতাহার হোসেন সাজু
এডভোকেট, আপীল বিভাগ
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।
সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।
২৪ মে’ ২০২০